ad

রোজা ভঙ্গ ও মাকরুহ হওয়ার প্রকৃত কারণসমূহ



ইসলামে রোজা পালন কেবলমাত্র খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরতি নয়, বরং এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য, ও নৈতিক আদর্শের একটি গভীর প্রকাশ। তবে, জীবনযাত্রার বিভিন্ন বাস্তবিক ও শারীরিক পরিস্থিতির কারণে রোজা রাখা কখনও কখনও ক্ষতিকর হতে পারে। তাই ইসলামী শাস্ত্রে নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ বলে গণ্য করা হয়েছে।

রোজা ভঙ্গ ও মাকরুহ হওয়ার প্রকৃত কারণসমূহ

Image generated using DALL·E Free.

অপরদিকে, কোনো বৈধ কারণ ব্যতীত ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করা, যা রোজার মূল উদ্দেশ্য ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে, তা মাকরুহ ও শাস্তিযোগ্য বলে বিবেচিত। এই নিবন্ধে আমরা সেই সকল কারণগুলো বিশদভাবে আলোচনা করব, যা রোজা ভঙ্গের বৈধ ও অবৈধ উভয় দিককে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে।

রোজা ভঙ্গের প্রকৃত কারণসমূহ

ইসলামের মূল নীতির অন্যতম হলো জীবনের সুরক্ষা ও শরীরের সুস্থতা। যখন শরীর বা মন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে, তখন রোজা ভঙ্গ করা বৈধ বলে বিবেচিত। নিচে সেই বৈধ কারণসমূহ তুলে ধরা হলো:

১. ইচ্ছাকৃত বমি করানো

যদি একজন রোজাদার নিজের ইচ্ছায় বমি করে এবং বমির বেশির ভাগ অংশ মুখের ভিতরে ফিরে আসে ও তা গিলে ফেলে, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হয়ে যায়। এখানে উদ্দেশ্য হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করানোর ফলে খাদ্য ও পানীয়ের শুচিত্ব নষ্ট হয়ে রোজার মর্যাদা হ্রাস পায়।

২. বমির বেশির ভাগের গিলানো

কখনও কখনও স্বাভাবিকভাবে বমি হলে ওষুধ বা অন্য কোনো কারণে বমির কিছু অংশ মুখে আসে। কিন্তু, যদি সেই বমির বেশির ভাগ অংশ গিলে ফেলা হয়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে মুখে আসা বমির মিশ্রণে উপস্থিত থাকা অপবিত্রতা রোজার শুদ্ধতাকে আঘাত করে।

৩. মহিলাদের মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব

মুসলিম মহিলাদের জন্য মাসিক ও সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাব একটি প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক ঘটনা। এই অবস্থায়, শরীরের প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি নারী শরীরের সুস্থতা ও আরাম রক্ষার জন্য একটি বৈধ ছাড়।

৪. ইসলাম ত্যাগ করা

একজন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ত্যাগ করে, তাহলে সে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন থেকে বঞ্চিত হয়। এই অবস্থায়, রোজা রাখা ইসলামী নীতির সাথে অসঙ্গত বলে ধরা হয়। তাই, ইসলাম ত্যাগ করলে রোজা ভঙ্গ করা অবশ্যক বলে গণ্য।

৫. গ্লুকোজ, শক্তিবর্ধক ইনজেকশন বা সেলাইন প্রদান

চিকিৎসা বা জরুরী পরিস্থিতিতে, গ্লুকোজ বা শক্তিবর্ধক ইনজেকশন ও সেলাইন দেওয়ার মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয়তা মেটানো যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, এই ধরনের ইনজেকশন গ্রহণ রোজার শর্ত ভঙ্গ করে, ফলে রোজা ভঙ্গের বৈধ কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

৬. প্রস্রাব-পায়খানার পথ দিয়ে ওষুধ বা অন্য কোনো পদার্থ প্রবেশ

শরীরে যে কোনো ধরনের ওষুধ বা পদার্থ যদি প্রস্রাব বা পায়খানার নালীর মাধ্যমে প্রবেশ করে, তাহলে তা রোজার মূল ধারণাকে ক্ষুণ্ণ করে। কারণ, খাদ্য ও পানীয়ের মতোই এই পদার্থও শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং রোজার শুদ্ধতা নষ্ট করে।

৭. জোর করে খাওয়ানো

যদি কোনো ব্যক্তি রোজাদারকে জোর করে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করে, তাহলে সেই পরিস্থিতিতে রোজা ভঙ্গ করা বৈধ বলে বিবেচিত হয়। এখানে রোজাদারের ইচ্ছার বিপরীতে কোনো বাহ্যিক চাপ সৃষ্টি হলে, তার নিরাপত্তা ও শারীরিক সুস্থতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব পায়।

৮. সূর্যাস্তের আগে ইফতার করা

রোজা ভঙ্গের আরেকটি বৈধ কারণ হলো, সূর্যাস্তের পূর্বে ইফতার করে নেওয়া। অর্থাৎ, যদি কেউ ভুলবশত বা ভুল ধারণায় ইফতারের সময় এসেছে মনে করে সূর্যাস্তের আগেই খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করে, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।

৯. রোজা থাকা অবস্থায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন

রোজা পালন করার সময় যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ। যদি এমন কোন কাজ ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়, তাহলে তা রোজার শর্ত ভঙ্গ করে এবং রোজা ভঙ্গের বৈধ কারণ হিসেবে গণ্য হয়।

১০. ভুলবশত খাওয়া ও পরবর্তীতে ইচ্ছাকৃত অতিরিক্ত গ্রহণ

কোনো সময় ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলা বা রোজা ভেঙে যাওয়ার ধারণা নিয়ে অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করলে, তা রোজা ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্দেশ্য হলো, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলকে আরও বাড়ানো এবং রোজার প্রাথমিক নিয়মাবলী থেকে বিচ্যুতি সৃষ্টি করা।

১১. বৃষ্টির পানি মুখে পড়া ও তা গিলে ফেলা

কখনও কখনও বৃষ্টির পানি মুখে পড়তে পারে। তবে, যদি সেই পানি সচেতনভাবে গিলে ফেলা হয়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে গণ্য করা হয়। এই ক্ষেত্রে, পানি শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশের মাধ্যমে রোজার শুদ্ধতা ক্ষুণ্ণ করে।

১২. কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ

ওষুধের ক্ষেত্রে, যদি কোনো ওষুধ বা পদার্থ কান বা নাকের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তা রোজার শর্ত ভঙ্গ করে। এই ক্ষেত্রে, খাদ্য ও পানীয়ের মত পদার্থ শরীরে প্রবেশ করে এবং রোজার মৌলিক নিয়মকে লঙ্ঘন করে।

১৩. জিহ্বা ব্যবহার করে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা কিছু তুলে গিলে ফেলা

দাঁতের ফাঁকে যে খাদ্যের অণু বা অবশিষ্টাংশ জমে থাকে, তা স্বাভাবিকভাবে শরীর থেকে নিষ্কাশিত হয়। তবে, যদি ইচ্ছাকৃতভাবে জিহ্বার সাহায্যে সেই অংশ তুলে নিয়ে গিলে ফেলা হয়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে ধরা হয়।

১৪. অল্প বমি হওয়ার পর ইচ্ছাকৃতভাবে বমি গিলে ফেলা

যদি রোজাদারের শরীরে অল্প পরিমাণ বমি হয়, কিন্তু তারপর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেলা হয়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের বৈধ কারণ হিসেবে গণ্য হবে। এখানে উদ্দেশ্য হলো, শরীরের অপবিত্র পদার্থের পুনঃঅন্তঃপ্রবেশ।

১৫. অজু বা কুলির সময় পানির ইচ্ছাকৃত প্রবেশ

যখন রোজা স্মরণে অবস্থায় অজু বা কুলি করার সময়, নাকে বা মুখের ভেতরে পানি প্রবেশ করলে, তা রোজার শুদ্ধতা ভঙ্গ করে। যদি এটি ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটে, তবে রোজা ভঙ্গের মধ্যে ধরা হয়।

রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণসমূহ

প্রকৃত কারণ ব্যতীত রোজা ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে, ইসলামী শাস্ত্রে কিছু নির্দিষ্ট আচরণ ও অভ্যাসকে মাকরুহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই ধরনের আচরণ রোজার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে, যার ফলে রোজার সঠিক ফজিলতাহীনতা রক্ষা হয় না। নিচে কিছু অবৈধ বা মাকরুহ কারণ তুলে ধরা হলো:

১. হারাম খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ

যদি রোজাদার সারা দিন রোজা পালন করেও, ইফতারের সময় এমন কোনো খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করে যা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম, তাহলে তা রোজার মর্যাদা কমিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে, যদিও রোজা শারীরিকভাবে বজায় থাকে, তবুও এর আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ ক্ষুণ্ণ হয়।

২. কোনো কারণ ব্যতীত শুধু চিবানো

রোজার সময় শুধু মুখে কোনো খাদ্যকে চিবানো, তা খেলেও না, শুধুমাত্র ঠোঁটের কাছে রেখে দেওয়াও মাকরুহ হিসেবে ধরা হয়। এখানে উদ্দেশ্য হলো, খাদ্যের সরাসরি অন্তঃপ্রবেশ রোজার নিয়মকে লঙ্ঘন করে।

৩. খাদ্য বা পানীয়কে মুখে রেখে খেলা

কোনো খাবার বা পানীয়কে শুধু মুখে রেখে, সেটিকে খেলাধুলার মতো ব্যবহার করলেও রোজার শুদ্ধতা ক্ষুণ্ণ হয়। এমন আচরণ ইচ্ছাকৃত হলেও তা রোজার মর্যাদাকে হ্রাস করে।

৪. নাকের মাধ্যমে পানি টেনে নেওয়া

কখনও কখনও রোজা পালনকারী ব্যক্তি নাকের মাধ্যমে অতিরিক্ত পানি টেনে নিতে পারেন। যদি এই পানির কিছু অংশ গলা দিয়ে পেটে চলে যায়, তবে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে ধরা হবে। যদিও এটি সচেতনভাবে করা না হলেও, ইচ্ছাকৃত বা দীর্ঘ সময় ধরে করলে তা মাকরুহ হয়ে যায়।

৫. মুখে লালা বা থুতুকে ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলা

স্বাভাবিকভাবে মুখে উৎপন্ন হওয়া লালা বা থুতু কোনো ক্ষতি করে না, কিন্তু যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা দীর্ঘ সময় ধরে মুখে রাখে এবং পরে গিলে ফেলে, তাহলে তা রোজার শুদ্ধতা ভঙ্গ করে। এই ধরনের আচরণকে মাকরুহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

৬. দাঁত পরিষ্কারের সময় পাউডার, পেস্ট বা মাজন ব্যবহার

দাঁত পরিষ্কারের সময় পাউডার, পেস্ট বা মাজন ব্যবহার করা স্বাভাবিক হলেও, যদি রোজাদার মুখে এসব পদার্থ প্রবেশ করে এবং তা গিলে ফেলা হয়, তাহলে তা রোজা মাকরুহ হিসেবে বিবেচিত হয়। যদিও প্রয়োজনের ক্ষেত্রে সামান্য স্বাদ চেখে দেখলে তা বৈধ, তবে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে তা সমস্যাজনক।

৭. মুখে গুল ব্যবহার ও থুতু সহ গলা ভেদ করে পানি প্রবেশ

গুল বা mouthwash ব্যবহার করা হলে তা স্বাভাবিকতায় মুখ থেকে বের হয়ে যায়, তবে যদি গুল বা থুতুর সাথে পানি নাক বা গলার ভেতরে চলে যায়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে খাদ্যের মতোই পদার্থের অনিচ্ছাকৃত অন্তঃপ্রবেশ রোজার শুদ্ধতা নষ্ট করে।

৮. সামাজিক অবহেলা ও নিন্দাপূর্ণ আচরণ

রোজা পালন কেবল শারীরিক নয়, আধ্যাত্মিক ও সামাজিক আদর্শের প্রতিফলনও। রোজা রেখে কারো গিবত করা, পরনিন্দা করা, মিথ্যা কথা বলা বা ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়া, এ সমস্ত আচরণ রোজার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে। এমন পরিস্থিতিতে রোজা মাকরুহ হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এটি ব্যক্তির নৈতিক ও সামাজিক আদর্শের প্রতি অবিচার।

৯. নাচ, গান ও বিনোদনে অতিরিক্ত লিপ্ততা

রোজা পালনকালে মন ও আত্মার শুদ্ধতা বজায় রাখতে বিনোদনমূলক কার্যকলাপ যেমন নাচ, গান, সিনেমা দেখা ইত্যাদির প্রতি সাবধান থাকার নির্দেশ আছে। যদি এ ধরনের বিনোদনে অতিরিক্ত লিপ্ত হওয়া হয়, তবে তা রোজার আধ্যাত্মিক গুরুত্বকে হ্রাস করে ও মাকরুহ হিসেবে বিবেচিত হয়।

১০. রান্নার সময় স্বাদ পরীক্ষা

রান্নার সময় খাদ্যের স্বাদ পরীক্ষা করা প্রয়োজনীয় হতে পারে। তবে, যদি রোজাদার ইচ্ছাকৃতভাবে লবণ, ঝাল বা অন্যান্য স্বাদ গ্রহণ করে, তবে তা রোজা মাকরুহের কারণ হয়ে যায়। বিশেষ প্রয়োজনে স্বল্প পরিমাণে চেখে দেখলে তা বৈধ হলেও, অনধিক পরিমাণে গ্রহণ করলে তা সমস্যার সৃষ্টি করে।

বাস্তব জীবনের উদাহরণ ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি

রোজা পালন কেবলমাত্র খাদ্য-পরিহারের সীমাবদ্ধতা নয়; এটি আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও আধ্যাত্মিক সচেতনতায় একটি মহৎ অনুশীলন। কিন্তু, বাস্তব জীবনে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি দেখা যায়, যেখানে রোজা রাখার শর্তগুলো ভঙ্গ হয়ে যায়। উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পাই যে, কিছু আচরণ যেমন ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করানো, নাক বা কান দিয়ে ওষুধ গ্রহণ করা কিংবা সামাজিকভাবে নিন্দা-গিবত করা – এসবই রোজার আধ্যাত্মিক ও শারীরিক শুদ্ধতাকে ক্ষুণ্ণ করে। ইসলামী ফিকহে এসব বিষয় সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং যদি কোনো ব্যক্তি বৈধ কারণ ছাড়াই এ ধরনের কাজ করে, তাহলে তা তার রোজার মর্যাদা ও পবিত্রতা নষ্ট করে।

ইসলামী শিক্ষায়, রোজার মূল উদ্দেশ্য হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন। যদি কেউ বৈধ কারণ ব্যতীত রোজা ভঙ্গ করে, তাহলে সে এই আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। ইসলামী শাস্ত্রে এ ধরনের আচরণকে গুরুতর পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যার ফলস্বরূপ পরে ক্ষয়ক্ষতি (কায়ামাহ) পূরণের বিধান রয়েছে।

উপসংহার

রোজা পালন আমাদের আধ্যাত্মিক ও শারীরিক শৃঙ্খলার অন্যতম উপায়। ইসলামী শাস্ত্র অনুযায়ী, যখন শরীর বা মন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা থাকে, তখন বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গ করা অপরিহার্য। অন্যদিকে, কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করা রোজার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে, যার ফলে তা মাকরুহ হিসেবে গণ্য হয়।

এই নিবন্ধে আমরা রোজা ভঙ্গের বৈধ কারণসমূহ – যেমন ইচ্ছাকৃত বমি, ভুলবশত খাওয়া, যাত্রা, মহিলাদের ঋতুস্রাব ও অন্যান্য শারীরিক অবস্থার পাশাপাশি, অবৈধ বা মাকরুহ আচরণসমূহ – নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, একজন রোজাদার ক্ষেত্রে সঠিক ও সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা যাতে সে বুঝতে পারে, কখন স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য রোজা ভঙ্গ করা উচিত এবং কখন তা ইচ্ছাকৃতভাবে ভঙ্গ করলে তা তার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সুতরাং, প্রতিটি মুসলমানের উচিত রোজা পালন করার সময় নিজের শরীর ও মনকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করা, যাতে রোজার সঠিক মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য রক্ষিত থাকে। বৈধ কারণ অনুযায়ী রোজা ভঙ্গ করা যদি প্রয়োজন হয়, তবে পরে ক্ষয়ক্ষতি পূরণের বিধান মেনে চলা উচিত, যাতে শারীরিক ক্ষতি কমে যায় এবং আধ্যাত্মিকভাবে পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।

সম্পূরক টেবিল: রোজা ভঙ্গের ও মাকরুহ হওয়ার কারণসমূহ

বিভাগ কারণসমূহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা
রোজা ভঙ্গের কারণ ইচ্ছাকৃত বমি করানো রোজাদারের ইচ্ছাকৃত বমি করার ফলে বমির অপবিত্রতা রোজার শুদ্ধতা নষ্ট করে।
বমির অধিকাংশ গিলানো বমি হওয়ার পর, যদি অধিকাংশ বমি মুখে ফিরে এসে গিলে ফেলা হয়, তা রোজা ভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে।
মহিলাদের ঋতুস্রাব মাসিক বা সন্তান প্রসবের পর ঋতুস্রাবের সময়, মহিলাদের শরীরের প্রাকৃতিক পরিবর্তনের জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ।
ইসলাম ত্যাগ ইচ্ছাকৃতভাবে ইসলাম ত্যাগ করলে, ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা থেকে বিরত থাকার কারণে রোজা ভঙ্গ করা বাধ্যতামূলক।
ইনজেকশন গ্রহণ (গ্লুকোজ, সেলাইন) চিকিৎসা বা জরুরী অবস্থায় ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরের প্রয়োজনীয়তা মেটানো হলে, তা রোজার শর্ত লঙ্ঘন করে।
প্রস্রাব-পায়খানার পথ থেকে ওষুধ প্রবেশ যদি ওষুধ বা অন্য কোনো পদার্থ প্রস্রাব বা পায়খানার নালীর মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, তা রোজা ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত।
জোর করে খাওয়ানো বাহ্যিক চাপের কারণে, রোজাদারকে জোর করে কিছু খাওয়ালে তার রোজা ভঙ্গ হয়ে যায়।
সূর্যাস্তের আগে ইফতার সঠিক সূর্যাস্তের পূর্বে খাদ্য গ্রহণ করলে, রোজা ভঙ্গ হিসেবে ধরা হয়।
রোজা মাকরুহ হওয়ার কারণ যৌন সম্পর্ক রোজার সময় অনিচ্ছাকৃত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা রোজার শর্ত ভঙ্গ করে।
ভুলবশত খাওয়া ও অতিরিক্ত গ্রহণ ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলা ও পরে ইচ্ছাকৃত অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করা রোজার নিয়ম লঙ্ঘন করে।
বৃষ্টির পানি গিলে ফেলা বৃষ্টির পানি মুখে পড়ে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলা হলে তা রোজা ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত।
কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ ওষুধ বা অন্য কোনো পদার্থ নাক বা কান দিয়ে শরীরে প্রবেশ করালে, তা রোজার শুদ্ধতা নষ্ট করে।
দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্য তুলে গিলে ফেলা ইচ্ছাকৃতভাবে জিহ্বার মাধ্যমে দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্য তুলে নিয়ে গিলে ফেলা, রোজার শুদ্ধতা লঙ্ঘন করে।
নাক বা মুখে পানি টেনে নেওয়া নাক বা মুখে অতিরিক্ত পানি টেনে নিয়ে যদি তা গলা দিয়ে পেটে চলে যায়, তাহলে তা রোজা ভঙ্গের কারণ হিসেবে ধরা হয়।
মুখে লালা/থুতু ইচ্ছাকৃতভাবে গিলে ফেলা স্বাভাবিক লালা বা থুতু যদি ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ সময় ধরে রাখা ও পরে গিলে ফেলা হয়, তা রোজার শুদ্ধতা নষ্ট করে।

FAQ - প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী

নীচে রোজা ভঙ্গ ও মাকরুহ হওয়ার বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর প্রদান করা হলো:

প্রশ্ন ১: কোন কোন অবস্থায় রোজা ভঙ্গ করা বৈধ?

উত্তর: গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা, ইচ্ছাকৃত বমি করা বা বমির অধিকাংশ গিলানো, মহিলাদের মাসিক বা ঋতুস্রাব, ইসলাম ত্যাগ, ইনজেকশন গ্রহণ (যেমন গ্লুকোজ বা সেলাইন), প্রস্রাব-পায়খানার পথ দিয়ে ওষুধ প্রবেশ, জোর করে খাওয়ানো, সূর্যাস্তের আগে ইফতার করা, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা, ভুলবশত খাওয়া ও পরে ইচ্ছাকৃত অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ করা, বৃষ্টির পানি গিলে ফেলা, কান বা নাক দিয়ে ওষুধ প্রবেশ করানো, দাঁতের ফাঁকে জমে থাকা খাদ্য তুলে গিলে ফেলা, অল্প বমি হওয়ার পর ইচ্ছাকৃতভাবে তা গিলে ফেলা, এবং অজু বা কুলির সময় পানির অনিচ্ছাকৃত প্রবেশ – এসবই বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গের অন্তর্ভুক্ত।

প্রশ্ন ২: ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গ করলে কেন তা মাকরুহ বলে গণ্য?

উত্তর: কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ করা, বা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে এমন কাজ করা, তা রোজার মূল উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ণ করে। এর ফলে, ব্যক্তির রোজার আধ্যাত্মিক ও নৈতিক মর্যাদা নষ্ট হয়ে তা মাকরুহ বলে গণ্য করা হয়।

প্রশ্ন ৩: রোজা ভঙ্গের সময় কি কি বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?

উত্তর: রোজা ভঙ্গের ক্ষেত্রে, শরীর ও মনকে সুরক্ষিত রাখতে অবশ্যই বৈধ কারণ অনুযায়ীই ভঙ্গ করা উচিত। এছাড়া, নাক, কান বা মুখে কোনো পদার্থ প্রবেশের ক্ষেত্রে, ওষুধ বা খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে ও সামাজিক আচরণে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন ৪: বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গ করলে পরে ক্ষয়ক্ষতি (কায়ামাহ) পূরণ করা কেন প্রয়োজন?

উত্তর: বৈধ কারণে রোজা ভঙ্গ করা মূলত শরীরের ও মনকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। পরে ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করা, সেই ক্ষতিপূরণের অংশ হিসেবে নেওয়া হয় যাতে শারীরিক ও আধ্যাত্মিক পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়।

প্রশ্ন ৫: রোজার শুদ্ধতা রক্ষা ও নৈতিকতার জন্য কী কাজগুলো এড়িয়ে চলা উচিত?

উত্তর: হারাম খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ, কোনো কারণ ব্যতীত শুধু চিবানো, নাক ও কান দিয়ে খাদ্য বা ওষুধ গ্রহণ, সামাজিকভাবে গিবত বা নিন্দাপূর্ণ আচরণ করা, অযথা বিনোদনে লিপ্ত হওয়া – এসব আচরণ রোজার শুদ্ধতা ও নৈতিক মূল্যবোধকে ক্ষুণ্ণ করে, তাই এড়িয়ে চলা উচিত।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আইটি দর্পণ'র নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url
ad
ad
ad
ad